একজন নারী একজন পুরুষ সব সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় কোনো দিক থেকেই কেউ কারও থেকে পিছিয়ে নয়। পরস্পর সমানে সমান। তারপরও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় অপসংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক কারণে নারীরা বিভিন্নভাবে পিছিয়ে আছে। শুধুই যে পিছিয়ে আছে তা নয়, এই দুর্ভাগ্যের ফলশ্রুতিতে নারীরা আত্মহত্যার প্রবণতায় এগিয়ে যাচ্ছে। এ সংখ্যায় পুরুষও কম নয়। এ কারনে চাই, সামাজিক আন্দোলন।এ আন্দোলন করেই দেশে বাল্য বিবাহ কমেছে।
- চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত মার্চ মাসে আমার চাঁপাই’র তথ্য মতে; মোট ৫ জন আত্মহত্যা করেছে।
৩ মার্চ বুধবার সকাল ১০ টার দিকে শিখা খাতুন (১৮) নিজ শয়ন কক্ষে আত্মহত্যা করে। তার মা মেয়েকে তার শয়ন কক্ষের ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে থাকতে দেখে চিৎকার দেয়। মায়ের চিৎকারে প্রতিবেশী ছুটে আসে এবং সদর মডেল থানায় খবর দেয়। সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ উদ্ধার করে।সে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার মসজিদ পাড়া এলাকার মোঃ সেন্টু আলীর মেয়ে। মানসিক চাপের কারনে সে আত্মহত্যা করে জানায় পুলিশ।
২১ মার্চ রবিবার দিবাগত রাত প্রায় ১১টায় তার নিজস্ব বাড়িতে সদর উপজেলায় প্রেমে ব্যার্থ হওয়ায় আকাশ ঘোষ (১৮) নামে একজন আত্মহত্যা। সে বালিয়াডাঙ্গা ইউনিয়নের নশিপুর এলাকার বিকাশ ঘোষের ছেলে। জানা যায়; প্রেমের জেরে নিজ বাড়ির দোতালায় ঘরের ফ্যানের হুকের সাথে গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যা করে।
২৮ মার্চ সোমবার রাত ৯টার দিকে নিজ শয়ন কক্ষের দরজা ভেতর থেকে আটকে ফ্যানের সাথে গলায় ওড়নার ফাঁস দেয় সাদিয়া। সে মহারাজপুর ইউনিয়নের আকন্দবাড়িয়া নতুনপাড়া গ্রামের সেলিম আলীর মেয়ে ও কারবালা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া খাতুন (১৫) । খবর পেয়ে রাত ১১ টার দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে পোঁছে মরদেহ উদ্ধার করে। জেদি প্রকৃতির সাদিয়া খাবার নিয়ে পরিবারের সাথে অভিমান করে এ ঘটনা ঘটায় বলে প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে পুলিশ।
একই দিনে রাত ১১ টার দিকে বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে যাবার পর বাড়ির বাইরের দিকের বারান্দায় বাঁশের খুঁটির সাথে গলায় রশির ফাঁস দেন রতন। সে নাচোল সদর ইউনিয়নের রাজবাড়ি মোহম্মদপুর জামকুড়ি গ্রামের সৌখিন খালকোর ছেলে রতন খালকো (৪০)।৩০ মার্চ মঙ্গলবার ভোররাত ৩ টার দিকে রতনের ছেলে ও মেয়ে পিতার মরদেহ ঝুলতে দেখে সকলকে খবর দেয়। পুলিশ সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে। পেটের পীড়া ও মানসিক যন্ত্রণায় রতন একাজ করেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে পুলিশ।
৩১ মার্চ বুধবার বিকেলে আলিনগরে ভাড়া বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও কলহের জের ধরে ফাতেমা ঘরে খাটের উপর চেয়ারে উঠে ওড়না পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে গলায় ফাঁস দেয়।সে সদর উপজেলার উচালিয়া পাড়া সরাইল বি. বাড়িয়া এলাকার সোহেল মিয়ার মেয়ে এবং ওসমান আলীর সহধর্মিণী ফাতেমা।
একসময় চোখের সামনে ঘন কুয়াশার আস্তরণ দেখা দেয়। আর সেই ঘন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে মানুষ কখনো কখনো প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদের ভাষা যখন নিজের জীবনকে হরণ করে তখন তাকে আমরা আত্মহত্যা বলি। আমাদের দেশে আত্মহত্যা বহুবিধ কারণে হয়ে থাকে। পারিবারিক সৃষ্ট কলহ চরম পর্যায়ে পৌঁছলে, যৌন হয়রানি, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, বহুবিবাহ, মান অভিমান, বিষণœতা, হতাশা, অন্তর দহন, স্বামীর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব, সম্পর্কের টানাপড়েন, বাল্যবিবাহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি।
বিজ্ঞানের ভাষায় বলা
যায়, মুড বা মেজাজের পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক পদার্থ,
নিউরোট্রান্স মিটারের গোপন সংশ্রব। এই পদার্থগুলোর মধ্যে সেরোটনিক ও নর এড্রিনালের
মাত্রা কমে গেলে মনোজগতে তৈরি হয় নিম্নচাপ। নিম্নচাপ থেকে আসে বিষণœতা। আর গুরুতর
বিষণœতা থেকেই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় মস্তিষ্কের
গ্লুটামিক অ্যাসিডের ভারসাম্যহীনতার সঙ্গে আত্মঘাতী আচরণের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন
গবেষকরা। যেসব মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে, গবেষণায় তাদের মস্তিষ্কের
গ্লুটামিক অধিক কার্যকর থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গ্লুটামিক হচ্ছে এক ধরনের
অ্যামিনো অ্যাসিড যা স্নায়ুকোষের মধ্যে সংকেতের আদান-প্রদান করে। কোষ থেকে কোষে
সংকেত পাঠাতে গ্লুটামিককে সহায়তা করে কুইনোলিক অ্যাসিড।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর অন্তত ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন। তবে আত্মহত্যা রুখতে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছেন। বিশেষজ্ঞরাও আত্মহত্যা রোধ করতে পরামর্শ দিচ্ছেন। জানা গেছে আত্মহত্যা রোধ করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে পরিবার। হু-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। আত্মহত্যার অন্যতম কারণ অবসাদ। টিনেজদের মধ্যে আজকাল আত্মহত্যার প্রবণতা সর্বাধিক।
একাকীত্বের কারণেও আত্মহত্যা করার অনেক উদাহরণ রয়েছে। চলুন জেনে নিই আত্মহত্যা রুখতে পরিবার যে ভূমিকা রাখতে পারে ‘মানসিক’ রোগ থেকে মুক্তি পেতে ভারতীয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রিয়াল দাস জানান, পারিবারিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের মাধ্যমে এই রোগের প্রতিকার সম্ভব। ‘আত্মহত্যার উপসর্গ’ সম্পর্কে পরিবারকে সচেতন হতে হবে এবং সেই অনুযায়ী রোগীর চিকিৎসা করতে হবে। এছাড়া আত্মহত্যার প্রতিরোধক হিসেবে দারুণ কাজ করে শরীরচর্চা। ব্যয়ামের ফলে শরীরে এক বিশেষ ধরনের হরমোন নির্গত হয়। যা ‘অ্যান্টি ডিপ্রেশন’-এর ওষুধ এবং স্বাভাবিকভাবে অবসাদ দূর করে।
চিকিৎসকের পরামর্শ: ১. আত্মহত্যা নিয়ে কথা না বলার ট্যাবু থেকে বেরিয়ে এসে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে। সমস্যা জানার চেষ্টা করতে হবে।
২. রোগীকে বোঝাতে হবে, তিনি যা ভাবছেন তা সঠিক ভাবনা নয়। সবসময় পাশে থাকতে হবে। চিকিৎসা চলাকালে রোগীকে একলা ছাড়া যাবে না। ‘সেলফ ডেসট্রাকটিভ বিহেভিয়ার’ লক্ষ্য করলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
৩. ধারালো অস্ত্র, ছুরি, কাঁচি, দড়ি- এই সমস্ত জিনিস রোগীর নজরের মধ্যে রাখা যাবে না।৪. সবসময় আশার আলো দেখাতে হবে। (সূত্র- এবিপি আনন্দ)
