চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামটি সাম্প্রতিককালের। ইতোপূর্বে এই এলাকা ‘নবাবগঞ্জ’ নামে পরিচিত ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, প্রাক-ব্রিটিশ আমলে এ অঞ্চল ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের বিহারভূমি এবং এর অবস্থান ছিল বর্তমান সদর উপজেলার দাউদপুর মৌজায়। নবাবরা তাঁদের পাত্র-মিত্র ও পারিষদসহ এখানে শিকার করতে আসতেন বলে এ স্থানের নাম হয় নবাবগঞ্জ। বলা হয়ে থাকে যে, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব সরফরাজ খাঁ (১৭৩৯-৪০ খ্রি) একবার শিকারে এসে যে স্থানটিতে ছাউনি ফেলেছিলেন সে জায়গাটিই পরে নবাবগঞ্জ নামে পরিচিত হয়ে উঠে। তবে অধিকাংশ গবেষকের মতে, নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে (১৭৪০-৫৬ খ্রি) নবাবগঞ্জ নামকরণ হয়। অষ্টাদশ শতকের প্রথম ও মধ্যভাগে বর্গীর ভয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে লোকজন ব্যাপকভাবে এ এলাকায় এসে বসতি স্থাপনের ফলে স্থানটি এক কর্মব্যস্ত জনপদে পরিণত হয়। কালক্রমে নবাবগঞ্জের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নবাবগঞ্জের ডাকঘর চাঁপাই গ্রামে অবস্থিত হওয়ায় নবাবগঞ্জ তখন ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ’ নামে পরিচিত হয়।
খ. প্রাচীনকালের চাঁপাইনবাবগঞ্জ (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৪ খ্রি):
ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদগণ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ এবং দার্জিলিং ও কোচবিহারসহ গঠিত সমগ্র অঞ্চলকে বরেন্দ্র এলাকা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই এলাকাকে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন অঞ্চল বলে মনে করার আরেকটি কারণ হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলেই সবচেয়ে প্রাচীন পুরাকীর্তি ও প্রত্নবস্ত্তর সন্ধান পাওয়া গেছে। আর বরেন্দ্রভূমির ইতিহাসের সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের ইতিহাস জড়িত। একসময় উত্তরবঙ্গের সিংহভাগ এলাকা পুন্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ধারণা করা হয়, এই পুন্ড্রবর্ধনই পরবর্তীতে গৌড় নামে পরিচিত হয়ে উঠে। পর্যটক ইবনে বতুতার বিবরণী থেকে জানা যায় যে, এই শহর গঙ্গা ও করতোয়া নদীদ্বয়ের মধ্যে কোনো স্থানে অবস্থিত ছিল। অবশ্য গৌড় রাজ্য সম্পর্কে কিংবদন্তীর অন্ত নেই। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের জৈনদের গ্রন্থে প্রদত্ত বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মালদহ জেলার লক্ষ্মণাবতী গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভবিষ্যপুরাণে বা ত্রিকান্ডশেষ গ্রন্থে গৌড়কে পুন্ড্র বা বরেন্দ্রর অন্তর্গত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চগৌড়ের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ‘ব্রজতরঙ্গিনী’ গ্রন্থে পরবর্তীতে বহু গ্রন্থে পঞ্চগৌড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে গৌড়, সারস্বত, কনৌজ, মিথিলা ও উৎকল নিয়েই এই পঞ্চগৌড়। কোনো এক সময় মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমানের কিয়দংশ ও মালদহ গৌড়ের অন্তর্গত ছিল । এ নিরিখে পন্ডিতগণ নবাবগঞ্জকে গৌড়ের অংশ হিসেবে মনে করেন।
গৌড়রাজ শশাঙ্কের সময় (আনুমানিক ৬০৬-৬৩৭ খ্রি) গৌড়ের অংশ হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ তাঁর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় রাজ্য সম্রাট হর্ষবর্ধন ও তাঁর মিত্র কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার অধীনে চলে যায়। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর বহিঃশত্রুর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে গৌড়ের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে ‘মাৎস্যন্যায়’ নামের শতবর্ষব্যাপী এক অন্ধকার ও অরাজক যুগের সূচনা হয়। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গৌড় রাজ্যে মাৎস্যন্যায় যুগের অবসান ঘটে প্রথম পাল রাজা গোপালের (আনুঃ ৭৫০-৭৭০ খ্রি) ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে। বাংলায় পাল শাসন প্রায় তিন শতাব্দীকাল স্থায়ী হয়েছিল। এরপর কর্ণাটক থেকে আগত ও রাঢ় অঞ্চলে বসবাসকারী সেন বংশ গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করে।
গ. মুসলিম শাসনামলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ (১২০৪-১৭৫৭ খ্রি):
ভাগ্যান্বেষী তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে নদীয়া জয় করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে। মুসলিম আমলে গৌড় নগরী ‘লখনৌতি’ (লক্ষণাবতী) নামে পরিচিতি লাভ করে। ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনামলে বাংলাভাষী সমগ্র ভূখন্ড ‘বাঙ্গালা’ নামের একক রাষ্ট্রের অধীনে আসে। তবে গৌড় তথা বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ ধরা হয় হোসেন শাহী বংশের শাসনকালকে। আর স্বাভাবিকভাবেই গৌড়ের পাদভূমি হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জনপদ তখন অভাবনীয় বৈষয়িক সমৃদ্ধি অর্জন করে। মধ্যযুগের বাংলার শ্রেষ্ঠ নরপতি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি) রাজত্বেই মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয়। আর সেই গৌরবের সাক্ষী হিসেবে আজও টিকে আছে গৌড়ের বিখ্যাত ছোট সোনামসজিদ।
১৫৭৬ খ্রি: মুঘল সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয়ের পর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের বেশিরভাগ এলাকা মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার কিছু কিছু এলাকায় তখন বার ভুঁইয়ারা মুঘলবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। যা হোক, মুঘল সুবাদারদের মধ্যে শাহাজাদা মুহম্মদ সুজার (১৬৩১-৫৯ খ্রি) বেশ কিছু কীর্তি চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে। তাঁর কাছারী বাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলার ফিরোজপুরে। তাঁর সময় গৌড়ের পূর্বাঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রঃ) এখানে আসেন। সুবাদার সুজা তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানান। পরে শাহ নেয়ামতুল্লাহ গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে ফিরোজপুরে স্থায়ীভাবে আস্তানা স্থাপন করেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি) পর থেকে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তখন থেকে বাংলা নবাবদের অধীনে একটি স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তার মর্যাদা ভোগ করতে থাকে। নবাব মুর্শিদকুলি খানের (১৭১৭-১৭২৭ খ্রি) সময় বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তর করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয় যা ভৌগোলিক দূরত্বের দিক থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অধিকতর নিকটবর্তী। পূর্বেই বলা হয়েছে, নবাবি আমলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকা নবাবদের মৃগয়াভূমি হিসেবে মুর্শিদাবাদের অভিজাত মহলে বেশ পরিচিত হয়ে ওঠে এবং ‘নবাবগঞ্জ’ নামটি মূলত ঐ সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে।
ঘ. ব্রিটিশ যুগ (১৭৫৭-১৯৪৭ খ্রি):
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা-ভারতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বীজ রোপিত হয়। বাংলার রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক রূপান্তর ঘটে এবং নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের পশ্চাদভূমি হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যে গুরুত্ব বহন করত, তাতে ভাটা পড়ে। তবে এ কথাও সত্যি যে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বর্তমানে আমরা যে গ্রামীণ ও শহুরে জনপদ কাঠামো দেখতে পাই তার সিংহভাগই ব্রিটিশ যুগে তৈরি। অবশ্য নবাবগঞ্জ অঞ্চলের ইতিহাস খুব প্রাচীন হলেও নবাবগঞ্জ থানা শহর ও মহকুমা শহরের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে পুর্ণিয়া ও দিনাজপুর জেলা ভেঙ্গে মালদহ জেলা গঠিত হয়, কিন্তু ১৮৫৯ খ্রিঃ পর্যন্ত এটিকে কোন কালেক্টরের অধীনে দেয়া হয়নি। Mr. Ravan Showছিলেন মালদহ জেলার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর। এ সময় শিবগঞ্জ ও কালিয়াচক থানাদ্বয় অপরাধপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে কুখ্যাত ছিল। নবাবগঞ্জ তখন শিবগঞ্জ থানার অধীনে একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল মাত্র। ১৮৭৩ খ্রিঃ মুন্সেফ চৌকি শিবগঞ্জ থেকে নবাবগঞ্জে স্থানান্তরিত হয় এবং তারও কিছুদিন পর ১৮৯৯ খ্রিঃ নবাবগঞ্জ থানায় উন্নীত হয়। থানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই নবাবগঞ্জ ও তার পার্শ্ববর্তী থানাগুলো নিয়ে একটি স্বতন্ত্র মহকুমা গঠনের পরিকল্পনা ও প্রয়াস চলতে থাকে। ১৮৭৬ খ্রিঃ পর্যন্ত নবাবগঞ্জ অঞ্চল রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ১৮৭৬-১৯০৫ খ্রিঃ সময়ে বিহারের ভাগলপুরের (বিভাগ) অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতোমধ্যে ১৯০৩ সালে ১২ জন ওয়ার্ড কমিশনারের সমন্বয়ে নবাবগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয়। ১৯০৫ খ্রিঃ বঙ্গভঙ্গের সময় তদানীন্তন পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশসহ এ অঞ্চলটি আবার অঞ্চল রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যদিও তা মালদহ জেলার অন্তর্গত থাকে। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে নবাবগঞ্জে সাবরেজিস্ট্রি অফিস স্থাপিত হলে এখানে কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। সরকারি কাজকর্মের সুবিধার জন্য ‘চাঁপাই’ গ্রামে অবস্থিত ডাকঘরটি ১৯২৫ সালে নবাবগঞ্জ শহরে স্থানান্তর করা হয় এবং তার নাম রাখা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ। সে সময় থেকেই নবাবগঞ্জ শহর চাঁপাইনবাবগঞ্জ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে।
ঙ. পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যুগ (১৯৪৭-বর্তমান সময়):
মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশেষ ঘটনাঃ
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় উন্নীত