Nov 1, 2020

নভেম্বরেই টিকার প্রস্তুতি শেষ করছে সরকার


আগামী বছরের জন্য অপেক্ষা নয়, ডিসেম্বরের মধ্যেই যেকোনো মাধ্যমে দেশে করোনাভাইরাসের যেকোনো সফল টিকা এসে যাবে—এমন সম্ভাবনা সামনে রেখেই হঠাৎ করে টিকা ব্যবস্থাপনাকেন্দ্রিক তৎপরতা বেড়ে গেছে সরকারের। টিকা পেতে অনেক দেরি হওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে এত দিন এই ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কাজে অনেকটাই ঢিলেঢালা ভাব ছিল। এখন নভেম্বর মাসের মধ্যেই সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। সংরক্ষণ, পরিবহন ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ, ক্রয়পদ্ধতি, টিকা প্রয়োগের কর্মী ও তাঁদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি গাইডলাইন তৈরির কাজ চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সহায়তায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরাও আছেন এই কাজের সঙ্গে। মোট ৯টি টিমে ভাগ হয়ে চলছে গাইডলাইন তৈরি ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার কাজ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকাকেন্দ্রিক গাইডলাইন ধরেই এগোচ্ছে এই কার্যক্রম।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি  বা ইপিআই) ডা. সামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখন আর আমরা দেরিতে টিকা আসার বিষয়টি মাথায় রাখছি না। বরং ডিসেম্বরের মধ্যেই আসতে পারে, সেদিকে নজর রেখেই নভেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি শেষ করতে চাই। এ জন্য কাজ করা কমিটিগুলো তাদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনাগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সেখান থেকে প্রয়োজনমতো যাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে।’ পাশাপাশি যাঁরা মাঠপর্যায়ে টিকা প্রয়োগ করবেন তাঁদের করোনার টিকা প্রয়োগের দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে কাজ চলছে বলে তিনি জানান। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ইপিআইয়ে যাঁরা আছেন তাঁদের মাধ্যমেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। সারা দেশে আমাদের ২২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ১৭ হাজার। বাকি পাঁচ হাজারের মতো পদ শূন্য। যদিও টিকা দেওয়ার সময় আরো স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ করা হবে; তাঁরাও প্রশিক্ষণ পাবেন।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গঠিত টিকা সমন্বয় উদ্যোগ বা কোভ্যাকসের শর্ত ও নীতিমালা অনুসারে, বাংলাদেশ মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ টিকা কোভ্যাকস থেকে পাবে। সেই হিসাবে তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য টিকা আসবে বাংলাদেশে। দুই ডোজের টিকা হলে লাগবে ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ। পুরোটা একবারেই আসবে না, আসবে কিস্তিতে কিস্তিতে। কোভ্যাকসের নির্ধারিত দাম অনুসারে প্রতি ডোজ টিকার জন্য দিতে হবে ১.৬ ডলার থেকে দুই ডলার পর্যন্ত। সেই হিসাবে প্রতি ডোজের দাম দুই ডলার ধরা হয়েছে। দুই ডোজের জন্য জনপ্রতি ধরা হয়েছে চার ডলার করে। আর এর সঙ্গে পরিবহন ও অন্যান্য খরচ বাবদ জনপ্রতি ধরা হয়েছে দুই ডলার করে। অর্থাৎ কোভ্যাকসের টিকা প্রয়োগে মাথাপিছু খরচ ধরা হয়েছে প্রাথমিকভাবে ছয় ডলার করে। তবে বেসরকারি কোনো কম্পানির কাছ থেকে যদি সরকার টিকা কেনে, এর দাম অনেক বেশি পড়বে। বেসরকারি কম্পানিও বেসরকারি পর্যায়ে টিকা বিক্রি করলে এর দাম কয়েক গুণ বেশি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে দাম বেঁধে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে কিভাবে টিকা সরকারের হাতে আসবে সেটা নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে। যেহেতু ধরে নেওয়া হচ্ছে, কোভ্যাকসের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে টিকা পেতে কিছুটা দেরি হতে পারে, তাই প্রয়োজনে সরকারের কাছ থেকেই আলাদা টাকা নিয়ে টিকা কেনা হবে। এ জন্য অর্থ বরাদ্দ করা আছে। দুই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই টিকা কেনার চিন্তা আছে। প্রচলিত সাধারণ ক্রয়প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে যেহেতু হাতে পেতে প্রায় তিন মাস চলে যায়, তাই প্রয়োজনে জরুরি বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা নিয়ে সরাসরি টিকা কেনার সুযোগ রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার নিজ উদ্যোগে সরাসরি দেশের বাইরের কোনো কম্পানি থেকেও টিকা সংগ্রহ করতে পারবে। স্থানীয় কোনো কম্পানি যদি টিকা এনে সরকারকে সরবরাহ করে, সেটারও পথ খোলা রাখা আছে।

ডা. সামসুল হক বলেন, ‘আপাতত ফাইজার বা মডার্নার টিকা নিয়ে ভাবনা কম, কারণ ওই দুটি কম্পানির টিকা যে তাপমাত্রায় পরিবহন ও সংরক্ষণ করতে হবে, সেই ব্যবস্থা আমাদের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নেই। এটা করা অনেক ব্যয়বহুলও। বরং আমাদের এখন সবচেয়ে বেশি নজর অক্সফোর্ড, রাশিয়া, ভারত ও চীনের টিকার দিকে। এগুলোর সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্য অনেকটা সহজ হবে। তবে যদি অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তখন অবশ্যই মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রার কোল্ড চেইনের ব্যবস্থা করতে হবে, সেটা যতই ব্যয়বহুল হোক না কেন।’

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মডার্না ও ফাইজারের সঙ্গে দেশের একাধিক ওষুধ কম্পানির যোগাযোগ রয়েছে। ওই দুই কম্পানি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের টিকা সরবরাহব্যবস্থার সঙ্গেই কোল্ড চেইন ব্যবস্থা যুক্ত করার চিন্তা করছে বলে সরকারকে জানানো হয়েছে। অর্থাৎ যে দেশে ওই টিকা যাবে সেই দেশে ওই কম্পানি নিজেরাই কোল্ড চেইনের দায়িত্ব পালন করবে। তবে এই বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানায় ওই সূত্র। পাশাপাশি সরকারের তরফ থেকে টিকা উদ্ভাবনকারী অন্যান্য কম্পানির সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। এমনকি বেসরকারিভাবে যে তৎপরতা চলছে, তা-ও সরকারের নজরদারির আওতায় রয়েছে। আর টিকা কেনার জন্য সরকার এরই মধ্যে ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে রেখেছে প্রাথমিকভাবে। অন্যদিকে চীনের সিনোভ্যাকের টিকার বাংলাদেশে ট্রায়ালের বিষয়টি ঝুলে থাকলেও ভারতের বায়োটেক ও সানোফির টিকার ট্রায়ালের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। এ ছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের টিকার ট্রায়ালের দায়িত্ব নিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।

টিকাকেন্দ্রিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই গতকাল শনিবার সাভারের জিরাবোতে ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেডের উৎপাদনকেন্দ্র পরিদর্শন করেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান। এ সময় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন, ইনসেপ্টার চিফ অপারেটিং অফিসার মাহবুবুল করীম, ইনসেপ্টার সাইট হেড সেলিম বারামী ও ডিজিএম (প্রশাসন) জাহিদুল আলমসহ অন্যরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। 

এ সময় মহাপরিচালক বলেন, ‘প্রতিবছর ১৮০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ইনসেপ্টার। এটি আমাদের সবার জন্য বড় সুখবর। সারা বিশ্বে যখন করোনা ভ্যাকসিনের বিপুল চাহিদা তৈরি হবে, তখন ওয়ার্ল্ড কমিউনিটি এই ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহার করবে বলে আমরা আশাবাদী।’

উল্লেখ্য, ইনসেপ্টার সঙ্গে এরই মধ্যে চীনের সিনোভ্যাক কম্পানির সমঝোতা হয়েছে বাংলাদেশে তাদের টিকা উৎপাদনের জন্য।

সংবাদটি শেয়ার করুন:

Author: verified_user

ই-মেইল: amarchapaibd@gmail.com