- কাজের গতি বেড়েছে দৃশ্যমান হচ্ছে স্টেশনগুলো
রাজন ভট্টাচার্য ॥ করোনায় বাধাগ্রস্ত হলেও নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে মেট্রোরেলের কাজ। ঢাকার সড়কে চলবে মেট্রোরেল। বিশে^র অন্যান্য উন্নত শহরের মতো এই শহরেও এমন স্বপ্নের বাস্তবায়ন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার কাজ এখন প্রায় পুরোপুরিই দৃশ্যমান। এ অংশে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৮০ ভাগ কাজের অগ্রগতির কথা জানিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। ২১ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে এ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি প্রায় অর্ধেক। এরমধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মেট্রোরেলের কাজ শেষ হবে আগামী বছরের ডিসেম্বরে। এজন্য বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে কাজের গতি। আগামী বছর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে এই প্রকল্পের উদ্বোধন হওয়ার কথা। অর্থাৎ আগামী বছর থেকেই মেট্রো রেলের যুগে পা রাখছে রাজধানী শহর।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উত্তরা থেকে মেট্রোরেল রুট মিরপুর হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এর মধ্যে উত্তরার একটি অংশে মেট্রোরেল লাইনের রেলট্রাক পুরোপুরি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় ৮০ ভাগ কাজ শেষে এখন মেট্রোরেলপথ এবং স্টেশন কাঠামো জানান দিচ্ছে কয়েকদিন পরেই চলবে স্বপ্নের ট্রেন। আর নতুন বছরের জানুয়ারিতে জাপান থেকে আসছে পাঁচসেট মেট্রো ট্রেন।
উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টর। এখানেই তৈরি হচ্ছে মেট্রোরেলের তৃতীয় স্টেশন ‘উত্তরা দক্ষিণ’। এরই মধ্যে স্টেশনটির কনকোর্স দেখা যাচ্ছে। কনকোর্স হলের নিচে প্ল্যাটফর্মের কাজ করছেন প্রকৌশলী-শ্রমিকরা। আর স্টেশনের দুই প্রান্তে চলছে মেট্রোরেল লাইনে নাট-স্ক্রু লাগানোর কাজ। লাইনের ঠিক ওপরে ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম টানা হয়েছে।
জানা গেছে, জানুয়ারিতে বাংলাদেশে আসছে পাঁচ সেট মেট্রো ট্রেন। এই ট্রেনগুলো দিয়েই উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের ১১ কিলোমিটারে ইন্টিগ্রেডেট টেস্ট ও ট্রায়াল রান হবে। ট্রেনগুলো আসার কথা ছিল চলতি বছরের জুলাই মাসে। কিন্তু করোনার থাবায় চীনের মতো বাংলাদেশও বিপর্যস্ত। সঙ্গত কারণে চীনে নির্মাণ করা এ ট্রেন তৈরিতে বেশ বিলম্ব হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় প্রকল্পের কাজের গতি যেমন বেড়েছে তেমনি ট্রেন নির্মাণের কাজও হচ্ছে দ্রুত গতিতে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও-এই অংশে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ছিল ৭৬ দশমিক ৩৭ ভাগ। এখন সে অগ্রগতি আরও বেড়েছে। মেট্রোরেলের প্রকল্প পরিচালক আফতাব উদ্দিন বলেন, মেট্রোরেলের বিদেশী প্রকৌশলী ও পরামর্শকরা চলে এসেছেন। তাদের স্বাস্থ্যগত সুরক্ষায় গাবতলী ও উত্তরায় দুটি ফিল্ড হাসপাতাল পরিচালনা করা হচ্ছে।’ মূলত জাপানী পরামর্শকরা ফিল্ড হাসপাতাল না থাকায় বাংলাদেশে আসতে আপত্তি দিয়েছিল বলে মেট্রোরেল সূত্র বলছে। সে কারণে ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণ করে তাদের দেশে আনা হচ্ছে।
এদিকে ডিএমটিসিএল ম্যানেজিং ডিরেক্টর এম এ এন ছিদ্দিক জানান, উত্তরা-মতিঝিল রুটে চলাচলের জন্য জাপানে কাওয়াসাকি কারখানায় দুই সেট মেট্রো ট্রেন নির্মাণ শেষ হয়েছে। আরও তিন সেট ট্রেন নির্মাণ শেষের দিকে। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে একসঙ্গে পাঁচ সেট ট্রেন দেশে এসে পৌঁছবে। তখন টেস্ট ও ট্রায়াল রান করা হবে উত্তরা আগারগাঁও অংশে।
উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও ঘুরে দেখা গেছে, ডিপো থেকে রেললাইন ভায়াডাক্টে উঠে গেছে। কিছু অংশে পুরোপুরি রেললাইন বসিয়ে স্ক্রু লাগানো হচ্ছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটারের কাজ হচ্ছে প্যাকেজ ৩ এবং ৪-এর অধীনে। তিন বছর আগে ২০১৭ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। দেখা গেছে, এখানে প্রায় ১১ কিলোমিটার উড়াল পথের মেট্রোরেল পথ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার উড়ালপথে রেললাইন ওভারহেড ক্যাটেনারি সিস্টেম বেড়া আকারের মাস্ট টানা হয়েছে।
এই ১২ কিলোমিটারে ৯টি স্টেশন রয়েছে। এগুলোর সাব স্ট্রাকচার নির্মাণ শেষ হয়েছে। উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ এই দুই স্টেশনের কনকোর্স বা ছাদ নির্মাণও প্রায় শেষ। এখন উত্তরা উত্তর, পল্লবী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া স্টেশনের কনকোর্স হলের কাজ চলছে। আর উত্তরা উত্তর ও উত্তরা দক্ষিণ ও উত্তরা সেন্টার স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ কাজ চলছে। এছাড়া উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের স্টিল স্ট্রাকচার বসানোর কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। আর উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের মেকানিক্যাল ইলেকট্রিক্যাল ও পাম্পিংয়ের কাজ শুরু য়েছে।
এদিকে মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে কমলাপুর অংশে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের পুরো নির্মাণ কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে।
সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএল আটটি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল দুটি অংশে ভাগ করে এগিয়ে চলছে চলমান রুট-৬ এর কাজ। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রুটে থাকছে ১৭ স্টেশন। ২১ কিলোমিটারের বেশি এই প্রকল্পে মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের বর্ধিত কাজ করার উদ্যোগ এখন প্রক্রিয়াধীন বলে জানা গেছে। এই অংশের দৈর্ঘ্য এক দশমিক ১৬ কিলোমিটার।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, করোনা মহামারীর মধ্যে মেট্রোরেলের কাজ থেমে না থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছে সীমিত আকারে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ইতোমধ্যে ১৭০ জনের বেশি আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। তাদের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন। মার্চ থেকে করোনা শুরুর পর ছয় মাস শেষে সেপ্টেম্বর থেকে ফের কাজ চলছে পুরোদমে। তবে আগারগাঁও-মতিঝিল অংশটি পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ হলো করোনার কারণে জাপানী ঠিকাদারদের নিজ দেশে আটকে পড়া। তবে জাপানী ঠিকাদারদের একটি অংশ ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন।
২০১৬ সালের ২৬ জুন এ প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়। এর আগে ২০টার মতো স্টাডি করা হয়েছে। এরপর এর বেসিক ডিজাইন করা হয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে এটার ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে।
দৈনিক পাঁচ লাখ যাত্রী পরিবহন করবে ॥ ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবেন মেট্রোরেলে। আর দৈনিক হিসাবে পাঁচ লাখ। ছয় কোচবিশিষ্ট ২৪ সেট ট্রেন চলবে প্রতিদিন। তবে ভবিষ্যতে আট কোচের ট্রেন করার পরিকল্পনা রয়েছে বলছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মাঝের চারটি কোচের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ৩৯০ জন, ট্রেইলার কোচের প্রতিটিতে ৩৭৪ জন যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে। প্রতিটি মেট্রো ট্রেনে যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা দুই হাজার ৩০৮ জন। ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলা এই ট্রেন তিন মিনিট ৩০ সেকেন্ড পর পর থামবে। ২১ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের কম। ইতোমধ্যে প্রথম মেট্রো ট্রেনের সামনের ও পেছনের নক্সা এবং বাইরের রং চূড়ান্ত হয়েছে। এতে লাল-সবুজের প্রাধান্য রয়েছে।
জানা গেছে, মেট্রোরেলে নারী যাত্রীদের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে প্রতিটি ট্রেনে একটি করে কোচ নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এতে প্রতি ট্রেনে প্রতিবার সর্বোচ্চ ৩৯০ জন নারী যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। নারী যাত্রীরা ইচ্ছা করলে অন্য কোচেও যাতায়াত করতে পারবেন।
১৭ স্টেশনে থামবে ট্রেন ॥ স্টেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, আইএমটি, মিরপুর সেকশন-১০, কাজীপাড়া, তালতলা, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, জাতীয় জাদুঘর, দোয়েল চত্বর, জাতীয় স্টেডিয়াম, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কমলাপুর। তবে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত নয়টি স্টেশন নির্মিত হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্টেশন নির্মাণের স্থানে আগে দুই পাশে যাতায়াত ব্যবস্থা করা হবে। তার পরেই সড়কের মিডলে কাজ শুরু হবে। মেট্রোরেল পরিচালনায় ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩ দশমিক ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত। এজন্য উত্তরা, পল্লবী, তালতলা, সোনারগাঁও ও বাংলা একাডেমি এলাকায় পাঁচটি বিদ্যুত উপকেন্দ্র থাকবে।