Nov 4, 2020

মানব পাচার রোধে জিরো টলারেন্সে সরকার


 

মানবপাচার রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। পাচাররোধে জিরো টলারেন্স দেখানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রশাসনকে। নেয়া হয়েছে দ্রুত বিচারসহ আরও কিছু উদ্যোগ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মানবপাচার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার জন্য কাজ করছে সরকার।

মানবপাচার নিয়ে সরকারের অবস্থান বরাবরই কঠোর। এত কিছুর পরও পাচার বন্ধ হয়নি। অনেক কাহিনী প্রকাশ পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই অবস্থা উত্তোরণে এবার বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন’ আইনের কঠোর বাস্তাবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। দেশের সাত বিভাগে সাতটি ‘মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে মানবপাচার মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। উদ্যোগ নেয়া হয়েছে মানবসম্পদ রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু আইনেরও সংশোধনের ।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সরকার মানবপাচার রোধ কল্পে কঠোর অবস্থান নেয়ার পরও মানবপাচার থেমে নেই। দেশের ৬৪ জেলায় পৌনে দুই লাখ মানবপাচার মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ৩০ হাজার ৭১১টি মামলা। গত ৮ বছরে গ্রেফতার করা হয়েছে ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জনকে। এই সময়ে সাজা হয়েছে ৫৪ জনের। তবে মামলা নিষ্পত্তির হার খুবই কম। মানবপাচারের শিকারে পরিণত হওয়া অনেকেই মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ায়, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের বনে জঙ্গলে থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশে মানবপাচারের অভিযোগ নতুন কোন ঘটনা নয়। কিন্তু সম্প্রতি লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনার পর তা পুনরায় দেশ-বিদেশে আলোচনায় উঠে এসেছে। লিবিয়ায় মানবপাচারের ঘটনায় অর্ধ শতাধিক দালালকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তদন্তও হচ্ছে। চলতি বছর ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলায় মানবপাচারের অভিযোগে দায়ের হওয়া ১ লাখ ৮০ হাজার ৬৭৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পুলিশের সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে পাচারকারীরা ইউরোপে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে মানুষকে লিবিয়ায় নিচ্ছে। সেখানে তারা অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ইউরোপে যেতে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকে মারা যান। ২০১২ সালে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনটি হওয়ার পর থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার মামলায় ৯ হাজার ৬৯২ জন গ্রেফতার হয়েছেন। আর ২০১৪ সাল থেকে এযাবত মাত্র ৫৪ জনের সাজা হয়েছে। গত প্রায় আট বছরে দেশে ৫ হাজার ৭১৬টি মামলা করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৪৭টি অর্থাৎ মাত্র ৪ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিচারাধীন আছে প্রায় ৪ হাজার ৪০৭টি মামলা।

অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি থেকে মানবপাচার মামলার নথির তথ্যানুযায়ী এক মামলায় ১১৮ বার তারিখ পড়ার পরও সাক্ষী পাওয়া যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থানার ২০০২ সালের একটি মামলায় সাক্ষী হাজির করার তারিখ পড়েছিল ৫৫ বার। তেজগাঁও থানায় ২০০৫ সালের একটি মামলায় পড়েছিল ৪৭ বার। এই ধরনের ১৮টি মামলায় বারবার তারিখ পড়ার তথ্য পেয়েছেন। ২০১১ সালে ফিরে এসে মামলা করেন একজন ভুক্তভোগী। সেই মামলা এখনও চলছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনে আছেন। অথচ এই আইনের মামলা জামিনযোগ্য নয়। এ ছাড়া আইনে সুযোগ না থাকলেও অনেক সময় দুই পক্ষ আপোস করে ফেলে। তখন মামলা চালানো কঠিন। আইন বলছে, ৯০ দিনের মধ্যে পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দেবে এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতে হবে। তেমন নজির প্রায় নেই। আইনটিতে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাবাস। সঙ্গে মোটা অর্থদ- আছে।

মানবপাচার মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, মামলার বিচারের ধীরগতি হওয়ার পেছনে চারটি কারণ। অভিযোগকারীর চেয়ে আসামিপক্ষ অর্থবিত্তে ক্ষমতাশালী হওয়া ও আসামিপক্ষ বেশি তৎপর থাকায় মামলার ওপর প্রভাব ফেলে। বাদীপক্ষ আদালতের বাইরে মীমাংসা করতে বাধ্য হয় এবং সেটি সম্ভব হয় অপরাধটির ভয়াবহতা নিয়ে প্রচার বেশি না থাকার কারণে। তারা এও বলছেন, কোন অপরাধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির না থাকলে, সেটি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয় না কোন পক্ষই। মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয় খুব জরুরী। সম্প্রতি লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের গুলিতে নিহত ২৬ জন বাংলাদেশী মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ ও যশোরের অধিবাসী ছিলেন। এসব জেলার মানবপাচার বিষয়ক আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটরদের সঙ্গে কথা বলেও মানবপাচারের চলমান মামলার দীর্ঘসূত্রতাসহ এই চার কারণ জানা যায়।

অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকে শুরু করে লিবিয়া পর্যন্ত চক্রের জাল বিছানো। পাচারকারীরা দফায় দফায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা নেন। দেশ থেকে হুন্ডি করে টাকা আনাতে হয়। লিবিয়ায় প্রায়ই কোন দল অপহরণ করে নিয়ে যায়। মুক্তিপণ দিতে হয়। অনেক সময় অভিবাসনের নামে পাচার চলে। ইউরোপে অভিবাসনের হাতছানিতে গত বছরও ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছে এবং উদ্ধার হয়েছেন অনেক বাংলাদেশী। লিবিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে ২০১১ সালে ৩৭ হাজার বাংলাদেশীকে ফেরত আনা হয়েছিল। তারপর দেশটি পাচারের পথ হয়ে ওঠে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে গড়ে ওঠা দালাল চক্র এলাকার লোককে এই পথে পাচারের ব্যবসায় যুক্ত।

অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ২৭ মে লিবিয়ায় গুলিতে হত্যা করা হয়েছে ২৬ জন বাংলাদেশীকে। ২ জুন র‌্যাব কামাল হোসেন ওরফে হাজী কামালকে (৫৫) গ্রেফতার করেছে। র‌্যাব বলছে, তিনি মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা। অভিজ্ঞজনেরা যদিও বলছেন, মূল ব্যক্তিরা সচরাচর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। মানবপাচার চক্রের মূল অংশটি দেশের বাইরে। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দালাল কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা তথ্য দেন না। মানবপাচার মামলায় সাক্ষী নিয়মিত পাওয়া যায় না।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০১২ সালে যে আইনটি করা হয়েছে, সেটি চমৎকার একটি আইন। তদন্ত ও শাস্তিসহ বেশকিছু বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। কিন্তু এই আইনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এছাড়া, জাতীয় যে কর্মপরিকল্পনা রয়েছে সেটাও ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মানবপাচারের মামলাগুলো বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যায়নি আট বছরেও। এ বছর সাতটি বিভাগে ট্রাইব্যুনাল চালু করে বিচার করার কথা আছে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনের যে আইনটি আছে তার বাস্তবায়ন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই ধরনের উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন করা গেলে মানবপাচার সংক্রান্ত ভয়াবহ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্মকর্তার দাবি।

সংবাদটি শেয়ার করুন:

Author: verified_user

ই-মেইল: amarchapaibd@gmail.com