- ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার ২০ প্যাকেজ ঘোষণা
- আগামী মাসের মধ্যে সব ঋণ বিতরণের নির্দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধিকাংশ ব্যাংকে এখন ঋণ দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে প্রণোদনার ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার পরামর্শ
রহিম শেখ ॥ করোনার চাপ কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতি। ব্যাংকিং খাতে শক্তি জোগাচ্ছে সরকারের ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ। প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণসুবিধা নিয়ে যাতে ব্যবসা-বাণিজ্য যথাসময়ে শুরু করা যায়, সে জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণের নির্দেশনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। ভর্তুকি সুদে প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের উদ্যোগ এবং এর সঙ্গে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকিং খাতে কর্মচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। প্রণোদনার ঋণের পাশাপাশি নানা নীতি-সহায়তার ফলে অধিকাংশ ব্যাংকে এখন ঋণ দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে। তবে প্রণোদনার ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে তৎপর থাকার পাশাপাশি বেসরকারী বিনিয়োগ আর কর্মসংস্থান বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
জানা গেছে, কোভিড-১৯ মোকাবেলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গত ৫ এপ্রিল বিভিন্ন খাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর বিভিন্ন সময়ে এই প্যাকেজের পরিমাণ বাড়িয়ে ১ লাখ ১১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকার মোট ২০টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এই প্রণোদনা প্যাকেজের ৭৫ হাজার কোটি টাকার বেশি জোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য বেশ কয়েকটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন এবং বিদ্যমান তহবিলের আকার বাড়ানো হয়েছে। এর আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকার মতো তহবিলের জোগান পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এ ছাড়া সিআরআর দুই দফায় দেড় শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে আরও ১৯ হাজার কোটি টাকা নতুন করে ঋণ দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে ব্যাংকগুলো। বাজেট বরাদ্দ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার জোগান দেয় সরকার। প্যাকেজের বাকি ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উৎস থেকেই বিতরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রেও ব্যাংকের যাতে সঙ্কট না হয়, সে জন্য তারল্য বাড়াতে তিন দফায় রেপো রেট কমিয়ে ৪.৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। চালু করা হয়েছে এক বছর মেয়াদী বিশেষ রেপো। ১৭ বছর পর ব্যাংক রেট ১ শতাংশ কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ব্যাংকের মুনাফা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফরাহ মোঃ নাছের জনকণ্ঠকে বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা যেন ব্যাহত না হয় সে জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এটা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেশের সব ব্যাংকে বারবার তাগাদা দেয়া হচ্ছে। এতে ঋণ বিতরণে আগের চেয়ে বেশ গতিও এসেছে।
জানা গেছে, ক্ষুদ্র, মাঝারিসহ প্রণোদনা প্যাকেজের সব ঋণ আগামী অক্টোবরের মধ্যে বিতরণ শেষ করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কৃষি ঋণ বিতরণ করতে হবে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। ফলে ব্যাংকগুলো এখন এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই বেশি ব্যস্ত রয়েছে। এর মধ্যে ৮৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে ভর্তুকি সুদে ঋণ আকারে। আর সামাজিক সুরক্ষা, অতি দরিদ্রদের এককালীন অনুদানসহ নানা উপায়ে দেয়া হয়েছে বাকি অর্থ। প্রণোদনার আওতায় কোন খাতে কী পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হবে, তা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য দেয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এরপর আরও দুই দফায় তহবিলের আকার আরও ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। এছাড়া সব গ্রাহকের এপ্রিল ও মে মাসের স্থগিত সুদের আংশিক ভর্তুকির জন্য দুই হাজার কোটি টাকা ইতোমধ্যে বিতরণ শেষ হয়েছে। আর ভর্তুকি সুদে শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ঘোষিত ৩৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে বেতন-ভাতা হিসেবে পাঁচ হাজার কোটি টাকাসহ প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া সিএমএসএমই খাতের ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৪২শ’ কোটি টাকা, কৃষি খাতের পাঁচ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১১শ’ কোটি টাকা, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিটের পাঁচ হাজার কোটি টাকার এক কোটি ১১ লাখ টাকা এবং রফতানি উন্নয়ন তহবিলে (ইডিএফ) নতুন করে যুক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ৯ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাণহীন অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার যখন প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তখনই সেটা বাস্তবায়নে নীতিমালা জারি করা হয়েছে। প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো যাতে কোন ধরনের সঙ্কটে না পড়ে সে জন্য বাজারে তারল্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ জানান, বড় বড় প্রতিষ্ঠান সরকারী প্রণোদনার মাধ্যমে সচল হলেও মাঝারি বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান সেভাবে প্রণোদনা পায়নি। তাই তাদের বিষয়ে ভাবার পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে প্রণোদনার ঋণের পাশাপাশি নানা নীতি-সহায়তার ফলে অধিকাংশ ব্যাংকে এখন ঋণ দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে। বাংলাদেশে করোনার প্রভাব শুরুর আগে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে অধিকাংশ ব্যাংকে আমানত সঙ্কট ছিল। ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদের আমানত পেতে মরিয়া ছিলেন ব্যাংকাররা। এসব ব্যাংক এখন ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে না। এখন সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য বেড়েছে। এই উদ্বৃত্ত তারল্যের অন্যতম কারণ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি-সহায়তা এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। প্রণোদনার আওতায় ৮৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন করছে। এরপরও কোন ব্যাংক যেন সঙ্কটে না পড়ে সে জন্য সিআরআর বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমার হার দেড় শতাংশ কমিয়ে দেয়ায় ব্যাংকগুলোতে ১৮ হাজার কোটি টাকার ঋণযোগ্য তহবিল তৈরি হয়েছে। আবার আমদানি ব্যয় কমলেও প্রচুর রেমিটেন্সের কারণে গত আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা সমপরিমাণ ৬৩৬ কোটি ডলার সরকারের দুই শতাংশ হারে ভর্তুকি রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। বাড়তি তারল্যের আলোকে ঋণ দিতে গিয়ে কোন ব্যাংক যেন সমস্যায় না পড়ে, সে জন্য সব ব্যাংকের ২ শতাংশ করে ঋণ দেয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ ব্যাংক খাতের জন্য শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। করোনার প্রভাব শুরুর মাস মার্চ শেষে যেখানে উদ্বৃত্ত ছিল ৮৯ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। এখন ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত তারল্য আরও বেড়েছে। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। আর ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৬৪ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। এতে ব্যাংকগুলোর গড় ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) দাঁড়িয়েছে ৭৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এর মানে বেশিরভাগ ব্যাংকের হাতে এখন প্রচুর ঋণযোগ্য তহবিল রয়েছে। জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যেই সবাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এখন ব্যবসা আনা এবং বিতরণ করা ঋণ যেন সঠিক খাতে ব্যবহার হয়, ব্যাংকারদের তা কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন এবং নীতি-সহায়তার কারণে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের আমানত বাবদ খরচ কমেছে। এতে তারল্য নিয়ে ব্যাংকগুলো এখন স্বস্তিতে আছে। তবে এসএমই খাতের তহবিল ব্যবস্থাপনায় এখনও ৯ থেকে ১০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। অথচ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হচ্ছে। আবার আমদানিসহ ট্রেডিং এখনও সেভাবে বাড়েনি। যে কারণে ব্যাংকগুলোর নন-ফান্ডেড ব্যবসা আগের পর্যায়ে আসেনি। সব মিলিয়ে এবারে ব্যাংকগুলো কতটা মুনাফা করতে পারবে তা নিয়ে শঙ্কা আছে।
এদিকে প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একের পর এক নীতি সহায়তা দেয়া হয়েছে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরুও করেছে অর্থনীতিতে। স্থবির আমদানি ও রফতানিতে গতি আসছে। মহামারীতেও রেমিটেন্স বেড়েছে অস্বাভাবিক গতিতে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও হয়েছে একের পর এক রেকর্ড। আর এখন বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়লেই অর্থনীতি পাবে কাক্সিক্ষত গতি। এ ছাড়া করোনার কারণে প্রথমবারের মতো ঋণগ্রহীতাদের বড় ধরনের ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণের অর্থ পরিশোধ না করলেও কোন ঋণগ্রহীতা খেলাপী হবেন না। একই সঙ্গে এপ্রিল ও মে মাসের ব্যাংক ঋণের সব সুদ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রফতানির অর্থ দেশে আনা ও আমদানি দায় পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে ১৮০ দিন বাড়ানো হয়েছে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির আওতায় স্বল্পমেয়াদী সাপ্লায়ার্স ও বায়ার্স ক্রেডিটের মেয়াদ। রফতানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে ৯০ দিন। প্রি শিপমেন্ট রফতানি সহায়তার জন্য গঠন করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল। এই তহবিল থেকে ৩ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছে ব্যাংকগুলো। আর ব্যাংকগুলোর গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে ঋণ দেবে। রফতানি উন্নয়ন তহবিলের আকার পাঁচ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। এই তহবিলে সুদহার কমিয়ে ২ শতাংশে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তহবিলে যুক্ত হওয়া দেড় বিলিয়ন ডলার বা ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানের জন্য গঠিত ইউরো গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ডের আকার ২০০ থেকে বাড়িয়ে ৪০০ মিলিয়নে উন্নীত করা হয়েছে। কমানো হয়েছে এই ফান্ডের সুদহারও।