নদী ড্রেজিংয়ের স্থায়ী পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, নদীর প্রবাহ যাতে ঠিক থাকে তাই নদীভাঙ্গন রোধে দেশের বড় নদীগুলোকে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে। পুরো বছর নিয়মিত ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাছাড়াও বর্ষাকালে যাতে নদীগুলোতে পানি ধরে রেখে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করা যায় তার ব্যবস্থা নিতেও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে এ নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।একনেক সভায় ২ হাজার ৪৫৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা খরচে ৪টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে সরকার দেবে ১ হাজার ৬৬৯ কোটি ৩১ লাখ, সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ১৮২ কোটি ১৪ লাখ এবং বিদেশী ঋণ ৬০৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। একনেক চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একনেক সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এবং শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী/সচিবরা সভায় কার্যক্রমে অংশ নেন। একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আসাদুল ইসলাম এবং পরিকল্পনা কশিমনের সদস্যরা সাংবাদিকদের সামনে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। এ সময় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী, কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মোঃ জাকির হোসেন আকন্দ, শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) মোসাম্মৎ নাসিমা বেগম, ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোঃ মামুন-আল-রশীদ উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফিংয়ে সচিব জানান, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন থাকতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সবাই যাতে মাস্ক ব্যবহার করে সেটি নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তুলে ধরে সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম বলেন, ড্রেজিংয়ের বিষয়ে যেসব প্রকল্প আছে সেগুলো দ্রুত একনেকে উপস্থাপনের জন্য অনুশাসন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ড্রেজিংয়ের বিষয়ে একটা স্থায়ী পরিবর্তনের এবং নিয়মিত ব্যবস্থাপনার জন্য একটা প্রকল্প নিতেও প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। আসাদুল ইসলাম বলেন, নদীর প্রবাহ বা পানি ব্যবস্থাপনার ওপর প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব দিয়েছেন। নদীর প্রবাহ ঠিক থাকে সে কথা বলেছেন। কারণ ভাঙ্গনের প্রধান কারণ নদীর পানি যখন কমে যায় তখন চর পড়ে বা অন্যান্য কারণে পানি বেড়ে গেলে ভাঙ্গন শুরু হয়। ফলে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, এসব বড় নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে পুরো বছর একটা ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা থাকতে হবে। সচিব আরও বলেন, দ্রুত চর জাগার কারণে যেসব নদীপথ পরিবর্তন হয় বা ভাঙ্গে এগুলো চিহ্নিত করে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। একইভাবে বর্ষাকালের পানি ধরে রাখার জন্য জোন তৈরি করতে হবে। যাতে পানির স্তর, অন্যান্য ব্যবস্থাপনা, পানির পরিমাণ বজায় থাকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন।
শুঁটকি শিল্প স্থাপন নিয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদনকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কক্সবাজারে শুঁটকি শিল্প স্থাপনের পর সেখানে যাতে লাভজনক মনে করে বাইরে থেকে জনগণ না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেননা এটি যেহেতু একটি পুনর্বাসন সংক্রান্ত প্রকল্প হবে। সেখাতে ক্ষতিগ্রস্তরাই কেবল যেন সুবিধা পায়। এছাড়া সময় মতো সব উন্নয়ন প্রকল্প শেষ করারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মোঃ জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ পানির ফ্লো (প্রবাহ) আসে, যে পরিমাণ বালু ও কাদামাটি নিয়ে আসে, এটা একদিকে আশীর্বাদ আরেক দিকে কষ্টের কারণ। আশীর্বাদ হলো নদীর পার্শ্ববর্তী কৃষিজমি, সেগুলোতে পলি পাচ্ছে। সমস্যা হলো, এর ফলে আমাদের নদীগুলোতে প্রতিনিয়ত চর পড়ছে। কারণ যখন চর তৈরি হয়, মাঝখানে চর তৈরি হলে পানি হয় ডান-বাম দিকে যাবে, নয়তো ভাগ হয়ে যাবে। যখন ভাগ হয়ে যায়, তখন দুদিকে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়।
আরেক প্রশ্নের জবাবে জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, বর্তমানে প্রকল্পভিত্তিক নদী ড্রেজিং কার্যক্রম চলছে। সেটি থেকে বেরিয়ে এসে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে যেতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে যেতে হলে পানিসম্পদ সচিব ও মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি, তাতে আমাদের মেইনটেনেন্স ড্রেজিংয়ের জন্য নিজস্ব ড্রেজার দরকার। অর্থাৎ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ড্রেজার দরকার। আমাদের সচল ড্রেজার আছে মাত্র ৫-৬টা। তারা ভাড়া করে নিয়ে আসে। তাদের ড্রেজিং সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ড্রেজারের একটা প্রকল্প দিয়েছে কিছুদিন আগে। এ প্রকল্পে ৬ হাজার কোটি টাকায় তারা ড্রেজার কিনবে মাত্র ৩২টা। সুতরাং সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কিন্তু বড় নদীগুলোতে আমরা স্টাডির মাধ্যমে মেইনটেনেন্স ড্রেজিংয়ে যাব। সেই ক্ষেত্রে নদীর ডান ও বাম তীর সংরক্ষণের প্রকল্প যে ঘন ঘন আসছে, হয়তো তখন একই নদীতে এরকম এত প্রকল্প আসবে না।
পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব জানান, একনেক সভায় দু’টি নতুন এবং দু’টি প্রকল্পের সংশোধন অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘যমুনা নদীর ডানতীর ভাঙ্গন থেকে সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলাধীন সিংড়াবাড়ী, পাটাগ্রাম ও বাঐখোলা এলাকা সংরক্ষণ’ প্রকল্প। এতে খরচ হবে ৫৬০ কোটি ৭ লাখ টাকা। ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘কক্সবাজার জেলায় শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন’ প্রকল্পটি ১৯৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা খরচে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ‘পাঁচদোনা-ডাঙ্গা- ঘোড়াশাল জেলা মহাসড়কে একস্তর নিচু দিয়ে উভয় পাশে পৃথক সার্ভিস লেনসহ চারলেনে উন্নীতকরণ (ডাঙ্গাবাজার-ইসলামপুর লিংকসহ)’ প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সংশোধনীতে খরচ বেড়েছে ৫৫১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। প্রকল্পটির মূল খরচ ছিল ৯৩৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এখন খরচ বেড়ে তা হয়েছে ১ হাজার ৪৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা। প্রকল্পটির সময়ও বেড়েছে ২ বছর। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল, তা এখন বাড়িয়ে করা হলো ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত।
বিদ্যুত বিভাগের ‘আমিনবাজার-মাওয়া-মংলা ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন’ প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন আনা হয়েছে। প্রকল্পটির ১ হাজার ১৪৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা খরচ বেড়েছে। প্রকল্পটির মূল খরচ ছিল ১ হাজার ৩৫৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এখন এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়াল ২ হাজার ৫০৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটির সময় বেড়েছে দেড় বছর। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ল।
একনেক সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন-কৃষিমন্ত্রী ড. মোঃ আব্দুর রাজ্জাক; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম; শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন; স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক; বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকসহ সভায় মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সচিব এবং উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।