Oct 23, 2020

সৌর সেচে ঝুঁকছে কৃষক, হাসছে ফসলের মাঠ



সৌরশক্তি নির্ভর কৃষি প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে সনাতন ধারণা। বিদ্যুতের লোডশেডিং, বাড়তি বিলের বোঝাসহ লো-ভোল্টেজের ভয়ে এখন ভীত নয় কৃষক। আর সেচ পাম্প চালাতেও হচ্ছে না ডিজেলের প্রয়োজন। সূর্যের আলোকে কাজে লাগিয়ে জমি ভেজাচ্ছে প্রয়োজন মতো। সনাতন পদ্ধতিকে পেছনে ফেলে সৌরশক্তি নির্ভর সেচ প্রযুক্তির দিকে ছুটছে এখন প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকরাও। দেশের ফসলের মাঠে সৌর সেচ সফলতায় মাঠে মাঠে এখন দেখা যাচ্ছে আধুনিক এই সেচ প্রযুক্তির ব্যবহার।


জানা গেছে, বিদ্যুত এবং ডিজেল ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাধ্যমে সেচ দেয়া হয় অনেক এলাকায়। এতে একদিকে কৃষিপণ্য উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। এ অবস্থায় কৃষি জমিতে সৌরশক্তির মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এর অংশ হিসেবে সৌরচালিত পাম্প স্থাপনের মাধ্যমে দুই হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে ভূ-উপরিস্থ পানিনির্ভর সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করা হবে। ফলে প্রতিবছর অতিরিক্ত ১১ হাজার টন খাদ্যশস্য ও শাকসবজি উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে কৃষি সংশ্লিষ্টরা। সেই সঙ্গে উপকৃত হবে ৬ হাজার ৬০০ কৃষক পরিবার।


এর আগে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, শেখ হাসিনার সরকার কৃষিবান্ধব। কৃষকদের সুবিধার জন্য সারে ভর্তুকি দিচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি দিচ্ছে। ক্ষুদ্র সেচসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে যাতে কৃষক উপকৃত হয়। যারা ফসল ফলায়, দেশকে খাদ্য নিরাপত্তা দেয়, কৃষক দরদী শেখ হাসিনা ও তার সরকার তাদের জন্য সব সময় নিবেদিত। কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মোঃ সায়েদুল ইসলাম বলেন, সূর্য থেকে প্রাপ্তির ফলে খরচ নাই। আর কৃষক সেচ ছাড়াও তার অন্যান্য গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার করতে পারে। এখন তো সবখানেই বিদ্যুত আছে এর পরেও যেখানে নাই সৌর সেচের মাধ্যমে সেখানেও কৃষক উৎপাদন ধারা অব্যাহত রাখতে পারছেন। 


যদিও কৃষকদের চাহিদা পূরণের পর বেশি থাকে আমরা জাতীয় গ্রীডে যুক্ত করতে চাই। দিন দিন কৃষকদের এ বিষয়ে আগ্রহ বাড়ছে।

জানা গেছে, সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন নামে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। ৮২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ের চলমান প্রকল্পটি ২০২৩ সালের মধ্যেই কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় সৌরশক্তিনির্ভর সেচ সুবিধা সম্প্রসারণসহ প্রকল্প এলাকায় আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন হবে। 


সৌরশক্তিনির্ভর সেচ প্রযুক্তির দিকে কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে কৃষি মন্ত্রণালয়ও এগিয়ে আসে সৌরশক্তিনির্ভর সেচ কার্যক্রম সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে। আর তাই প্রকল্পের আওতায় ২০০টি সৌরশক্তি চালিত লো-লিফট পাম্প (এলএলপি) স্থাপন করা হবে। নির্মাণ করা হবে ২০০ পাম্প হাউস। চলমান এই প্রকল্পে গত বছর এক কিউসেক (দৈনিক ১০ লাখ লিটার পানি উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন) ১৫টি এবং হাফ কিউসেক ৮টিসহ মোট ২৩টি সৌরপাম্প স্থাপন করা হয়েছে। সেচকৃত এলাকা ৩৫৬.৫ হেক্টর এবং নির্মাণকৃত বারিডপাম্প সেচনালা ৩৫.৫ কি.মি. রয়েছে। যেখানে সরাসরি প্রায় দুই হাজার কৃষক পরিবার উপকার পাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোঃ সারওয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, সৌরশক্তির ব্যবহার কৃষকদের মধ্যে একটা সাড়া ফেলেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় ও বিএডিসি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি। করোনার একটা ধাক্কা থাকলেও কাজ থেমে নেই। কৃষক পরিবারগুলো সরাসরি উপকার পাচ্ছে, অতিরিক্ত ফসল আসবে। আমরা মনে করি এতে কৃষকদের অনেক সাশ্রয় হবে।


প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, কৃষি উৎপাদনে সেচ অন্যতম প্রধান নিয়ামক। বোরো মৌসুমে মূলত বিদ্যুত ও ডিজেলচালিত গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে সেচ দেয়া হয়ে থাকে। অনেক সময় আমন মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাওয়ায় সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হয়। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বৃদ্ধিসহ বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় কৃষি ব্যয়বহুল হচ্ছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা টেকসই করার লক্ষ্যে সেচ কাজে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারসহ সৌরশক্তিনির্ভর সেচ কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে বিদ্যুতের সাশ্রয়সহ ফসলের চাষাবাদ লাভজনক করা প্রয়োজন। প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, দেশের ৩৪টি জেলার ১৪১ উপজেলায় এ সেচসুবিধা দেয়া হবে। মূল কাজের মধ্যে রয়েছে দুই শ’টি সোলার পাম্প, ৫০টি সৌরশক্তি চালিত ড্রাগওয়েল, ৫০টি ডিপ ইরিগেশন, ১৪০ কি. মি. বারিড পাইপ সেচনালা হবে। সরকার আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০,০০০ সোলার পাম্প স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বিএডিসি সৌরশক্তির সাহায্যে সেচপাম্প পরিচালনার বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের ভিত্তিতে ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থ বছরে ‘ঢাকা বিভাগে সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুদ্রসেচ উন্নয়ন কর্মসূচী’ নামে ১১টি সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্প (এলএলপি) স্থাপনের একটি কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে। বর্তমানে বিএডিসি বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচীর মাধ্যমে ১৭৮টি সৌরপাম্প স্থাপন করেছে। এছাড়া বিএডিসি আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে সারাদেশব্যাপী ১০০০টি সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্প স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। বিএডিসি, ইডকল, বিএমডিএ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪৫০টি সৌরপাম্প স্থাপন করা হয়েছে।


কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৌরশক্তির মাধ্যমে সেচযন্ত্র পরিচালনা করা হলে শুষ্ক মৌসুমে বিদ্যুত ও ডিজেলের বাড়তি চাহিদা অনেকাংশে দূর করার পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ হতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে যখন মাঠে ফসল থাকবে না তখন এই সৌরবিদ্যুত দ্বারা ধান মাড়াই, ধান ভাঙ্গানো, ব্যাটারি চার্জসহ গৃহস্থালী কাজেও ব্যবহার করা যাবে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সেচে বিদ্যুত সাশ্রয়সহ ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ওপর চাপ কমবে, যা পরিবেশের ভারসাম্য উন্নয়নে ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া বিদ্যুতের অভাবে সেচ কার্যক্রম বিঘিœত হচ্ছে এমন এলাকায়ও সেচ কার্যক্রম পরিচালিত করা যাবে।


জানা গেছে, বিদ্যুতবিহীন চর অঞ্চলে সৌরশক্তির ব্যবহার কৃষিতে পরিবর্তন এনেছে। বিএডিসি রংপুর বিভাগের চর অঞ্চলে মোবাইল সৌর প্যানেল ও পাম্প স্থাপনের মাধ্যমে সেচ কাজ পরিচালনা করছে। এছাড়া বিএডিসি ডাগওয়েলে প্যানেল আকারে সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে কূপ থেকে পানি উত্তলন করে ডিপ ইরিগেশন পদ্ধতিতে সবজি ও ফুলের চাষে যশোর ও শেরপুর জেলায় ব্যাপক সারা ফেলেছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন:

Author: verified_user

ই-মেইল: amarchapaibd@gmail.com